পঞ্চগড়ে মাদ্রাসায় ২৩ পারা হাফেজার রহস্যজনক মৃত্যু
পঞ্চগড় প্রতিনিধি: পঞ্চগড়ে সুমনা (১৩) নামে এক মাদ্রাসাছাত্রী রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছে। নিহত সুমনা পঞ্চগড় সদর উপজেলার পানিমাছপুকুরি এলাকার নূরে আলম সিদ্দিকের মেয়ে।
সে পঞ্চগড় শহরের তাওহীদ মডেল মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থী ছিল।
মাদ্রাসা সূত্রে জানা যায়, ১৮ মে বিকেলে হঠাৎ সুমনা বমি করতে শুরু করে। দুইবার বমি করলে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে পঞ্চগড় সদর আধুনিক হাসপাতালে নেওয়া হয়। তবে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
নিহতের বড় বোন আমেনা খাতুন জানান, কিছুদিন আগে সুমনা কান্নাকাটি করে তার পা জড়িয়ে বলেছিল, আমাকে আর ওখানে পাঠাইও না। ওরা আমাকে পড়াশোনার সুযোগ দেয় না, শুধু কাজ করায়। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। ওরা আমাকে বাঁচতে দেবে না। তুমি মা-বাবাকে বলো, আমি আর ওখানে যেতে চাই না।
আমেনার অভিযোগ, মাদ্রাসার মুহতামিমের পুত্রবধূ সুমনাকে অতিরিক্ত কাজ করাতেন এবং গালিগালাজ করতেন।
তিনি আরও বলেন, আমার বোনকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জায়গায় কাজের জন্য পাঠানো হতো। আমেনার ধারণা, সুমনাকে ইলেকট্রিক শক (কারেন্ট শট) দিয়ে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। সুমনার লাশ গোসল করা সুমনার আত্মীয় জানান, সুমনা এক হাত বাঁকা ছিল, মুখের ডান পাশে গালে ও মাথায় আঘাতের চিহ্ন দেখেছেন তিনি।
নিহতের আরেক বোন জান্নাতুল ফেরদৌস জুলি বলেন, আমার বোন পুরোপুরি সুস্থ ছিল। মাত্র দুইবার বমি করলেই কেউ মারা যায়? যখন আমি তার মরদেহ ছুঁয়ে দেখি, তখন মনে হচ্ছিল সে কয়েক ঘণ্টা আগেই মারা গেছে। এটি কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়, আমি এর সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চাই।
তিনি আরও বলেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমাদের মাদ্রাসায় ডেকে বলে, ‘আপনারা যে আমানত দিয়েছেন, সেই আমানতের খেয়ানত হয়ে গেছে।’ আমার প্রশ্ন, আমার বোন যদি মারা গিয়ে থাকে, তাহলে তারা সেটা গোপন করল কেন? কেন আগে হাসপাতালে নিয়ে যায়নি?
সুমনার বাবা নূরে আলম সিদ্দিক জানান, মাদ্রাসা থেকে ফোন করে বলা হয়, আমার মেয়ে গুরুতর অসুস্থ। আমরা গাড়ি ভাড়া করে মাদ্রাসায় যাই, গিয়ে দেখি মেয়ে সেখানে নেই। পরে তারা জানায়, মেয়েকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি, সে মৃত। তখন আমার কিছু বুঝে ওঠার মতো অবস্থা ছিল না। আমাকে বলা হয়, একটি অঙ্গীকারনামায় সই করতে হবে, তবেই মেয়ের লাশ নিতে পারবো। কিছু না বুঝেই আমি সই করে মেয়ের মরদেহ নিয়ে আসি।
সুমনার মা বলেন, ১৮ মে রোববার সন্ধ্যায় মাদ্রাসা থেকে ফোনে বলা হয়, সুমনা কয়েকবার বমি করেছে, চিনি খাইয়ে দেওয়া হয়েছে, সে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছে, হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বলা হয়, আপনার স্বামীকে নিয়ে চলে আসুন। মাদ্রাসায় গেলে তারা বলেন, যে আমানত দিয়েছেন, তা রাখতে পারিনি। আমি হাসপাতালে গিয়ে দেখি, আমার মেয়ে নিথর দেহ হয়ে পড়ে আছে।
তিনি আরও বলেন, মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ আমাকে বোঝায়, আপনার মেয়ে হাফেজা, সারাজীবন পর্দা করেছে, এখন যদি ময়নাতদন্ত করা হয়, তার দেহ কাটা হবে, পুরুষ ডাক্তার দেখবে। আমি তখন ভাবলাম, আমার মেয়ে অনেক কষ্ট করে হাফেজ হয়েছে, পরপুরুষকে না দেখিয়ে দাফন করা ভালো। কাটা ছেঁড়ার ভয়েই আমি ময়নাতদন্তের দাবি ছাড়ি এবং দাফনের ব্যবস্থা করি। এখন আমি জানতে চাই, আমার মেয়ে কীভাবে মারা গেল?
সুমনার দুলাভাই শান্ত জানান, মাদ্রাসার সহ-সভাপতি আবুল বাশার নিজেকে জিনাত লাইফস্টাইল এবং ‘স্যামসাং শোরুম’–এর মালিক হিসেবে পরিচয় দেন এবং সুমনার মা-বাবাকে এমনভাবে বোঝান যে তারা আর কিছু বুঝতে পারেননি। শান্ত বলেন, তিনি বলেছিলেন, আপনার মেয়ে ২৩ পারা হাফেজা ছিল, এখন ময়নাতদন্ত করলে সুইপার তার দেহ উলঙ্গ করে নেড়েচেড়ে দেখবে, এমন কথা বলে তার বাবা-মাকে ব্রেনওয়াশ করেন। এতে তারা আর আমাদের কথা শুনতেই চাননি।
এদিকে মাদ্রাসার মুহতামিম লাকি নাহার বলেন, সুমনা সাত বছর ধরে এখানে ছিল। সে খুব ভালো ও ভদ্র মেয়ে ছিল। মাগরিবের নামাজের সময় কেউ এসে জানায়, সে তিনবার বমি করেছে। আমি তখন চিনি খাওয়ায় দিয়ে রিকশা ডেকে সাতটা সাত মিনিটে হাসপাতালে পাঠাই। সাতটা তেরো মিনিটে আমরা হাসপাতালে পৌঁছাই। চিকিৎসক তখন তার অভিভাবকের খোঁজ করেন, আমি সঙ্গে সঙ্গেই তাদের খবর দিই। সে কীভাবে মারা গেল, তা আমার জানা নেই।
পঞ্চগড় সদর থানার ওসি (তদন্ত) জানান, পরিবারের পক্ষ থেকে কোনো অভিযোগ না থাকায় আমরা মরদেহটি আইনানুগভাবে হস্তান্তর করি।
পরিবারের সদস্যদের দাবি, সুমনার মৃত্যু স্বাভাবিক নয় এবং এটি সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা উন্মোচন করা প্রয়োজন।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available